শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:৪৩ পূর্বাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
কিমের সঙ্গে যায়, রুহানির সঙ্গে কেন নয়?

কিমের সঙ্গে যায়, রুহানির সঙ্গে কেন নয়?

পারমাণবিক উত্তেজনার জের ধরে উত্তর কোরিয়াকে ধ্বংস করার হুমকি দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উন যুক্তরাষ্ট্রকে পুড়িয়ে ছাই করার কথা বলেছিলেন।

বছর দেড়েক আগেও ট্রাম্প ও কিমের মধ্যে অনেকটা ‘সাপে-নেউলে’ সম্পর্ক ছিল। পারলে তো একজন আরেকজনকে ‘কাঁচা চিবিয়ে খায়’ দশা। পরস্পরকে সে কী চোখরাঙানি! কথায় কথায় হুমকি-ধমকি। প্রকাশ্যে একে অন্যকে ‘অকথা’ বলতেও ছাড়েননি এই দুই খ্যাপাটে নেতা।

অথচ সেই ট্রাম্প-কিমই কিনা এখন ভালো ‘বন্ধু’। গত এক বছরের মধ্যে তাঁরা তিন তিনবার মুখোমুখি হয়ে বৈঠক করেছেন। প্রত্যেকবারই ট্রাম্প ও কিম হাতে হাত রেখে মিষ্টি হাসি হেসে হৃদ্যতার বার্তা দিয়েছেন। এই সময়ে তাঁরা বার কয়েক ‘ভালোবাসার’ চমৎকার চিঠিও বিনিময় করেছেন। শুধু তা-ই নয়, এখন উভয়ে উভয়ের প্রশংসায় গদগদ।

খেয়ালি ট্রাম্প নাটক খুব ভালোবাসেন। জাপান থেকে দক্ষিণ কোরিয়া যাওয়ার প্রাক্কালে গত শনিবার ট্রাম্প এক টুইটে সবাইকে চমকে দেন। দুই কোরিয়ার মধ্যবর্তী অসামরিক এলাকায় (ডিএমজেড) গিয়ে কিমকে ‘হ্যালো’ বলে তাঁর সঙ্গে শুধুই ‘মোলাকাত’ করার ইচ্ছা পোষণ করেন ট্রাম্প।

যেই কথা, সেই কাজ। টুইটের পর দিন রোববার সত্যি সত্যি ডিএমজেডে হাজির হন ট্রাম্প। মার্কিন প্রেসিডেন্টের আহ্বানে সাড়া দিয়ে উত্তর কোরিয়ার নেতাও ডিএমজেডে আসেন। সেখানে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। দুজনের মধ্যে হাসিমুখে হ্যালো হয়, হয় মোলাকাত।

একপর্যায়ে কিমের আহ্বানে সীমান্তরেখা পেরিয়ে উত্তর কোরিয়ার মাটিতে পা রাখেন ট্রাম্প। জন্ম দেন ইতিহাস। ক্ষমতাসীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনিই প্রথম উত্তর কোরিয়ায় পা রাখেন। পরে ফিরে এসে দুই নেতা সংক্ষিপ্ত বৈঠক করেন। ট্রাম্পকে পিয়ংইয়ংয়ে আসার আমন্ত্রণ জানান কিম। ট্রাম্পের কাছ থেকে কিম পান হোয়াইট হাউসে যাওয়ার দাওয়াত।

ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চরম উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। পারমাণবিক বোমার বোতাম নিজের টেবিলেই রাখা আছে জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে শাসান কিম। ট্রাম্পও কম যান না। তাঁর পারমাণবিক বোমার বোতাম কিমের চেয়ে বড় ও শক্তিশালী বলে জানিয়ে দেন ট্রাম্প।

গত বছরের জানুয়ারিতেই ট্রাম্প ও কিম পারমাণবিক বোমা নিয়ে এই পাল্টাপাল্টি হুমকি দেন। তার অল্প সময়ের ব্যবধানে ‘রকেটম্যান’ কিমকে আপন করে নেন ‘বুড়ো’ ট্রাম্প। নিভৃতচারী উত্তর কোরিয়ার কর্তৃত্ববাদী শাসক এখন বিশ্ব গণতন্ত্রের সোল এজেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ‘মহান বন্ধু’।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে শত্রুকে বন্ধু করে নেওয়াটা অবশ্যই প্রশংসনীয় কাজ। তাতে বিশ্বেরও মঙ্গল। কিন্তু সব সময় সব ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের এমন ‘উদার’ মনোভাব লক্ষ করা যায় না। এই যেমন ইরানের প্রতি ট্রাম্পের মনোভাব আগাগোড়াই বৈরী।

যুদ্ধের ঝংকার কোরীয় উপদ্বীপ থেকে সরে এখন পারস্য উপসাগরে অবস্থান করছে। ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনার পারদ বেড়েই চলছে। এই উত্তেজনা যেকোনো সময় যুদ্ধের রূপ নিতে পারে। গত সোমবারও ট্রাম্প হুমকি দিয়ে বলেছেন, ইরান আগুন নিয়ে খেলেছে।

ইরানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি উদারপন্থী নেতা হিসেবেই দেশ-বিদেশে পরিচিত। তাঁর ক্ষমতার প্রথম মেয়াদেই ২০১৫ সালে বারাক ওবামার যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বশক্তিগুলোর সঙ্গে ইরানের ঐতিহাসিক পারমাণবিক চুক্তি হয়। এই চুক্তির জন্য ওবামা ও রুহানি দুজনই প্রশংসা কুড়ান।

২০১৬ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় এলে বিশ্ব এক নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। ট্রাম্পের মতিগতি বোঝা বড় দায়। তিনি কখন কী বলেন, আর কখন কী করেন, তা বোঝার সাধ্য কারও নেই। সম্ভবত, এ কারণেই তিনি পাগলাটে কিমের হাতে হাত রাখতে পারেন, তাঁর সঙ্গে বসতে পারেন, কিন্তু উদার রুহানির সঙ্গেই তাঁর যত সমস্যা।

তবে কি কিমের চেয়েও রুহানি রূঢ়? কিমের চেয়েও ভয়ংকর? নিঃসন্দেহে নয়। ২০১৫ সালে রুহানিকে চুক্তিতে আনা গেছে। কিন্তু কিম যেই-সেই। ট্রাম্পের সঙ্গে কিমের তিনটি বৈঠক হয়েছে বটে। তার মধ্যে প্রথম দুটির ফলাফল ‘অশ্বডিম্ব’। আর সবশেষ বৈঠকটির অর্জন এখনো অজানা।

১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকেই ইরানে সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুতার শুরু। অবশ্য বিপ্লবে উৎখাত হওয়া রাজতান্ত্রিক স্বৈরশাসক রেজা শাহ পাহলভির সঙ্গে আমেরিকার ছিল গভীর দহরম-মহরম। পরের কালে রাষ্ট্রীয় বৈরিতার ছাপ একসময় সাধারণ মানুষের মনেও পড়ে। যুক্তরাষ্ট্রে এখন ইরানবিরোধী মনোভাব প্রবল। রিপাবলিকান ট্রাম্প একদিকে কট্টর মুসলিমবিরোধী, অন্যদিকে ইরানবিরোধী।

নির্বাচনী প্রচারের সময়ই ট্রাম্প ইরান ও ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তির বিরুদ্ধে মুখর ছিলেন। ক্ষমতায় বসে কলমের এক খোঁচায় পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নেন তিনি। পাশাপাশি ইরানের ওপর নতুন করে অবরোধ আরোপ করেন। সম্প্রতি ট্রাম্প ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতাকেও মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় এনেছেন।

২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও ট্রাম্প প্রার্থী হচ্ছেন। ভোটে ইরান-বিকারকে পুঁজি করতে দেশটির বিরুদ্ধে আক্রমণ আরও জোরদার করে চলছেন ট্রাম্প। মাঝেমধ্যে তিনি আলোচনার কথা বলছেন হয়তো। তবে শর্ত—তালগাছটা তাঁরই। ইরান কেন জেনেশুনে ট্রাম্পের এই টোপ গিলবে?

ইসরায়েলের পরম বন্ধু ট্রাম্প। তাঁর ঘরে, প্রশাসনে গিজগিজ করে ইসরায়েলি শুভাকাঙ্ক্ষী, লবিস্ট ও চর। অনুমিতভাবেই ইসরায়েলের জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করছেন ট্রাম্প। ইসরায়েল দিনরাত ইরানের বিনাশ চায়। ট্রাম্পকে দিয়ে ইরানকে দমন করতে তারা একের পর এক কার্ড খেলছে। ট্রাম্পও ইসরায়েলি চশমায় ইরানকে দেখে তেহরানের বিরুদ্ধে নানান শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছেন।

ইসরায়েলের মতো সৌদি আরবও ইরানের বিরুদ্ধে বিরামহীনভাবে প্রকাশ্যে-গোপনে কলকাঠি নেড়ে চলছে। আঞ্চলিক রাজনীতির প্রবল প্রতিপক্ষ ইরানের বিরুদ্ধে লড়তে ইসরায়েলের সঙ্গে হাত মেলাতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি সৌদি আরব। অন্যদিকে, রিয়াদের পাশে পেয়ারে দোস্ত ওয়াশিংটন তো আছেই। তার ওপর ট্রাম্পের সঙ্গে সৌদির বর্তমান বাদশা ও যুবরাজের আছে দহরম-মহরম খাতির। এই সুবাদে তাঁরাও ইরানের বিরুদ্ধে ট্রাম্পকে কাজে লাগাচ্ছেন।

যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও সৌদি আরব—এই তিন দুষ্টুচক্রের বদনজরে পড়ে ইরান আছে মহাফ্যাসাদে।

সাইফুল সামিন: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877